Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

মেলা, রথ, লোকশিল্প ও চারুকলা

চাঁদপুর জেলার মেলাসমূহ

বাঙালি জাতির অনেক উৎসব আয়োজনের সঙ্গে মিশে আছে মেলা বা আড়ং- এর ঐতিহ্য। চাঁদপুরেও বেশ কিছু প্রাচীন ও স্বাধীনতাত্তোর  সৃষ্ট মেলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। উপজেলা ভিত্তিক উল্লেখযোগ্য মেলাসমূহের বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলোঃ

চাঁদপুর সদর

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা:বিজয় দিবসকে চির স্মরনীয় করে রাখার জন্য চাঁদপুর হাসান আলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সম্মুখস্থ হাসান আলী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার আয়োজন করা হয়। এ মেলা হয় প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ১ম সপ্তাহে আরম্ভ হয়। চলে এক মাস। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর শহর পাকবাহিনী মুক্ত হয়। ১৯৯২ সালে ৮ ডিসেম্বর বিজয় মেলা আরম্ভ হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব রাখা এবং বিশিষ্ট বিদগ্ধ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁরা মেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ইতিহাস জনসমক্ষে তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় শিশু খেলনা হতে আরম্ভ করে মহিলাদের বিভিন্ন তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী পাওয়া যায়। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার নতুন কমিটি গঠন করা হয়। বিজয় মেলা কমিটিই এ মেলার আয়োজক। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা কমিটির ১ম আহবায়ক ছিলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব এম, এ ওয়াদুদ, জেলা কমান্ডার এবং ২০১১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার আহবায়ক ছিলেন এডভোকেট জনাব আব্দুল লতিফ গাজী। মেলার মঞ্চে প্রতিদিন আলোচনা সভা ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। জেলার সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন এসকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকে।

বাবুর হাটের বৈশাখী মেলাঃ চাঁদপুর সদর উপজেলার বাবুরহাট বাজারে স্বল্প পরিসরে প্রতিবছর বৈশাখী মেলা বসে। এটি  একটি  স্বতঃস্ফুর্ত মেলা।

বড় ষ্টেশন মোল হেড চত্তরের ১লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ও মেলাঃ ২০১০ ইংরেজি মোতাবেক ১৪১৭ বাংলা সনের ১লা বৈশাখ জেলা প্রশাসক জনাব প্রিয়তোষ সাহার উদ্যোগে চাঁদপুরে সর্বপ্রথম বৃহত্তর কলেবরে বড় স্টেশন মোল হেড চত্ত্বরে উদযাপন করা শুরু হয়। প্রথমে সাংস্কৃতিক সংগঠসমূহের মৃদু বিরোধীতা থাকলেও জেলা প্রশাসক জনাব সাহার প্রচেষ্টায় সকলের ঐকমতেই চাঁদপুর হাসান আলী মাঠ থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালীসহ মোল হেড চত্ত্বরে গিয়ে ১লা বৈশাখের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। এ বৈশাখী অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ্য করে জেলা প্রশাসক জনাব প্রিয়তোষ সাহা, পুলিশ সুপার জনাব   মুহাম্মদ  শহিদুল্যাহ চৌধুরী, পিপিএম এবং চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জনাব নাসির উদ্দিন আহমেদ এর নেতৃত্বে মোল হেডটি অবৈধ দখল মুক্ত হয়। মেয়র জনাব নাসির উদ্দিন আহমেদ ১লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে মঞ্চ, মাইক ও প্যান্ডেলের ব্যবস্থা করেন এবং জেলা প্রশাসক অন্যান্য সকল আয়োজন করে থাকেন। জেলা প্রশাসক ১লা বৈশাখ উপলক্ষে প্রায় চার-পাঁচ হাজার মানুষকে মঞ্চের অদূরে অবস্থিত রেলওয়ে রেস্ট হাউসে পান্থা ইলিশ খাওয়ানোর ব্যবস্থা নেন। এ অনুষ্ঠানে সেলফোন কোম্পানি ‘‘রবি’’ সহযোগিতা করে। এ পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে ঘিরে ১৪১৭ বাংলা সন থেকে মোল হেড চত্ত্বরে মেলা বসছে। ঐ দিন চাঁদপুর ও তার আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার নারী পুরুষ অনুষ্ঠানে ও মেলায় যোগ দেয়। মেলায় খেলনা, পিঠা ও হ্যান্ডি ক্রাফট, খাদ্য সামগ্রী ইত্যাদি পাওয়া যায়।

মেলা উপলক্ষে একটি আকর্ষনীয় র‌্যাফেল ড্র হয়। মেলা। সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান করে থাকে। ১৪১৮ সনের মধ্যরাতে উদিচি কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠান ‘ইতিহাস কথা কও’ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসকসহ শিল্পী কলা কৌসুলী ও দর্শক শ্রোতারা প্রবল ঝড়ের মুখে পড়েন। কোন ক্ষয় ক্ষতি না হলেও আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং প্যান্ডেল ও মঞ্চ তছনছ হয়ে যায়।  

হাইমচর উপজেলা

          মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলাঃ ‘প্রজন্ম বাংলাদেশ হাইমচর’ নামক একটি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে ২০০৭ সাল হতে প্রতি বছর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ডিসেম্বর মাসের সুবিধাজনক একটি সময়ে দূর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এ মেলার আয়োজন করা হয়। মেলাটি অত্যন্ত জাঁকজমক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় নাগরদোলা এবং দেশীয় নানাবিধ ষ্টল বসে। প্রতিদিন মেলা মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটকের প্রদর্শনীসহ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত প্রামান্য চলচিত্র প্রদর্শন করা হয়। 

মতলব দক্ষিণ উপজেলাঃ

মেহেরনের রথের মেলাঃ প্রতি বছর মতলবের মেহেরন হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা উপলক্ষে ঐতিহাসিক মেহেরন রাধকৃঞ্চ মন্দির প্রাঙ্গনে  মেলা বসে। প্রতি  জুলাই মাসে রথযাত্রা কমিটি রথ মেলা আয়োজন করে থাকে। মেলায় বিভিন্ন রকমের শিল্পজাত দ্রব্য সামগ্রী যেমন মাটির পুতুল, হাঁড়ি পাতিল, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, কাঠ, বাঁশ ও বেতের তৈরী জিনিস পত্র পাওয়া যায়।

মতলব উত্তর উপজেলাঃ

          ঐতিহ্যবাহী লেংটার মেলা ও অন্যান্য মেলা ঃমতলব উত্তর উপজেলায় উত্তরাংশ অর্থাৎ মেঘনা ধনাগোদা নদী বেষ্টিত দ্বীপাঞ্চল  (মেঘনা নদীর পশ্চিমাংশসহ) ২০০০ সালে ‘‘মতলব উত্তর’’ উপজেলা নামে নতুন উপজেলা গঠিত হলেও শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। গ্রাম বা সমাজ নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের উদ্যোগে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। কিছু কিছু মেলা অনুষ্ঠিত হয় পীর, আওলিয়া,  দরবেশ, ফকিরদের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। এদের মধ্যে লেংটা বাবা (সোলেমান শাহ)’র মাজার বদরপুর পুলিশ ফকিরের দরগাহ (গজরা), আইন উদ্দিন শাহ’র মাজার, বড় হলদিয়া মেলা অন্যতম। সবচেয়ে  সুপরিচিত হলো লেংটা বাবার মাজারে অনুষ্ঠিত মেলা। সারা দেশ থেকে লেংটা ভক্তবৃন্দ এখানে আসেন। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের ১৮-২১ তারিখ পর্যন্ত ০৪ দিন এবং চৈত্র মাসের ১৫-২২ তারিখ পর্যন্ত এই  ৮ দিন মেলা চলে। মেলায় যাত্রা ও আকর্ষণীয় সার্কাস দেখানো হয়।

           মেলায় তাঁত, কামার-কুমারদের তৈরী বিভিন্ন দ্রবাদি কেনা বেচা হয় এবং বিভিন্ন প্রকার খেলনা ও হরেক রকমের খাবার পাওয়া যায়। এ ছাড়া ৩০ শে চৈত্র এবং পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এলাকার হাট/ বাজারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ স্থানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ সকল মেলায় বিভিন্ন প্রকার খাবার, নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য ও খেলনা পাওয়া যায়। বহু পূর্বে রাঢ়ীকান্দি গ্রামে মেলা হতো এবং এ মেলায় ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। এ মেলার প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে মেলাটি ‘বট’ গাছের নীচে অনুষ্ঠিত হতো।

 

হাজীগঞ্জ উপজেলাঃ

         মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা ও অন্যান্য মেলা সমূহঃএ উপজেলায় হাজীগঞ্জ বাজারের ঐতিহ্যবাহী বালু মাঠ নামক স্থানে প্রতি বছর ১লা জানুয়ারী থেকে ১ মাস ব্যাপী এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ‘‘মুক্তিযুদ্ধ বিজয় মেলা’’ হয়ে থাকে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এখানে শিল্পীদের আকাঁ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ছবি, কুটির শিল্পজাত, হস্ত শিল্পজাত  দ্রব্যাদি বেচা কেনা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এ প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয় বিধায় এটি একটি প্রসিদ্ধ মেলা। সাধারণত স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, হাজীগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় এ মেলার আয়োজন করা হয়। এছাড়া এ উপজেলায় নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট বৈশাখী মেলা হয়ে থাকে।

শাহরাস্তি উপজেলাঃ

মেহার কালী বাড়ীর কালীপূজার মেলাঃ  উপমহাদেশের অন্যতম পবিত্র পাঠস্থান মেহার কালীবাড়ি শাহরাস্তি উপজেলা সদরে অবস্থিত। দ্বিপাস্বিতা কালী পূজা উপলক্ষে এখানে মাসব্যাপী মেলা ও দিপালী উৎসব উৎযাপিত হয়। বাংলা সনের কার্তিক মাসে এ মেলা বসে।

মেহার কালী বাড়ীর পৌষ মেলাঃ মেহার কালীবাড়িতে প্রতি বছরে ৭-১৫ দিন ব্যাপী পৌষ মেলা উদযাপিত হয়। মেলায় বহু লোকের সমাগম ঘটে।

বৈশাখী মেলাঃ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রতি বছরই মেহার কালীবাড়ি মাঠে ১ দিনের মেলা উদযাপিত হয়। জানা যায় প্রায় ৫শ বছর যাবত এ মেলা উদযাপিত হয়ে আসছে। মেলা উদযাপন কমিটি উক্ত মেলার আয়োজন করে থাকে।হিন্দু সম্প্রদায়ের দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধ পীঠস্থান হওয়ায়  মেহার কালী বাড়ী সনাতন ধর্মালম্বীদের নিকট বিখ্যাত। এজন্য এ কালীবাড়ীতে মেলারও গুরুত্ব অপরিসীম। হিন্দু, মুসলিম সকল ধর্মের লোকজন একত্রে এ সকল মেলার আয়োজন করে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলাঃ

        পহেলা বৈশাখের মেলাঃ প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় কর্তৃক গাব্দেরগাঁও নারিকেলতলা নামক স্থানে কালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কালী পূজা কমিটি’র উদ্যোগে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ১লা বৈশাখে এখানে বৈশাখী মেলা বসে। মেলায় দেশীয় খাবার এবং মাটির তৈরী পুতুল ও দেশীয় লোক ও কারু শিল্প পণ্য বিক্রি হয়।

          আষ্টার মহামায়ার বৈশাখী মেলাঃ আষ্টা মহামায়া মন্দির প্রাঙ্গন ও মন্দির সংলগ্ন আষ্টা বাজারে প্রতিবছর ২রা বৈশাখ বিরাট বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শত বছরেরও বেশী সময় ধরে এ স্থানে বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মন্দির কমিটি ও আষ্টা বাজার ব্যবসায়ী কমিটির যৌথ পরিচালনায় প্রাচীনতম এ মেলা আয়োজন করা হয়ে থাকে। মেলায় হিন্দু-মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের বহু লোকের সমাগম হয়। মেলাতে দেশীয় ঋতু ভিত্তিক ফল, মিষ্টি জাতীয় তৈরি খাবার, মাটির তৈরি পুতুল, দেশীয় লোক ও কারুশিল্পের পণ্য ইত্যাদির দোকান বসে এবং এ সকল পণ্য বিক্রি হয়। 

কচুয়া উপজেলাঃ 

সাচারের রথের মেলাঃ চাঁদপুর জেলাধীন কচুয়া উপজেলার অর্ন্তগত ১নং সাচার ইউনিয়নের সাচার গ্রামস্থ তৎকালীন হিন্দু জমিদার ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিত্ব স্বর্গীয় গঁঙ্গা গোবিন্দ সেন মহাশয় পারমার্থিক ধনার্জনে ব্যাকুল হয়ে ১২৭৪ বঙ্গাঁব্দে তীর্থ দর্শনের নিমিত্তে ভারতের শ্রীক্ষেত্রে গমন করেন। পাথৈর নিবাসী স্বর্গীয় গোলক চন্দ্র দাস মহাশয় সহ আরো অনেকে তাঁর (সেন মহাশয়ের) সহযাত্রী ছিলেন। গয়া, কাশি ও বৃন্দাবন সহ অনেক র্তীথ পর্যটন শেষে তিনি সর্বশেষ নীলাচলস্থ শ্রীক্ষেত্রে দারুব্রহ্ম শ্রী হরিকে দর্শনের জন্য আসেন। সেখানে জগন্নাথ দেবের কৃপালাভ ও তার মহাপ্রসাদ সেবন করে পার্থিব জগতের সকল পাপ বিমোচন ও পৌরলৌকিক মুক্তি লাভের মাধ্যমে নিজ জীবন ধন্য করার প্রত্যাশায় সেন মহাশয়ের মন অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠল। তিনি জগন্নাথ দেবের শ্রী বিগ্রহ দর্শনের জন্য শ্রীক্ষেত্রে অবস্থিত জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করলেন কিন্তু বার বার চেষ্টা করেও জগন্নাথ দেবের দর্শন পেলেন না। হয়তো বা ভক্তের ভক্তি নিষ্ঠা পরীক্ষার জন্যই জগন্নাথদেব অপ্রকট রইলেন। জগন্নাথ দেবের দর্শন না পেয়ে সেন মহাশয় তখন অত্যন্ত মর্মাহত হলেন এবং অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী ও ঘৃণ্য পাপী মনে করে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি জগন্নাথের দেখা না পাবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোন অন্ন জল গ্রহন করবেন না। তিনি অনশন করে নিজ দেহ ত্যাগের সংকল্প করলেন। এভাবে তাঁর তিন দিন গত হলো। তাঁর সঙ্গীগন তাঁকে অনেক সান্ত্বনা দিলেও তিনি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। অনাহারে অনিন্দ্রায় তিনি মৃত প্রায় হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় একদা রাতে জগন্নাথ দেব কৃপা পরবশ হয়ে স্বপ্নাদেশে সেন মহাশয়কে বললেন যে, ‘‘আমাকে যে ভক্ত ভক্তি ভরে ডাকে আমি যে তার হয়ে যাই। আমার ভক্তকে আমি কখনো ছেড়ে যেতে পারিনা। তুমি শান্ত হও। তুমি স্বপ্নে আমার যে রূপ দর্শন করলে আমি সেরূপেই তোমার নিজ নিবাস সাচারে আবির্ভূত হবো। তুমি বাড়ী ফিরে গিয়ে আমার শ্রী মূর্তি গঠন করবে। আমি সাচারে দারুব্রহ্মরূপে প্রকাশিত হবো।’’ এভাবে জগন্নাথ দেব স্বপ্নে সেন মহাশয়কে সান্ত্বনা দেন। জগন্নাথ দেবের শুভাদেশ পেয়ে প্রফুল্ল চিত্তে দেশে ফিরে এসে সেন মহাশয় এ শুভ সংবাদটি সাচার বাসীকে জানান এবং জগন্নাথদেবের শ্রী বিগ্রহ বিনির্মাণের জন্য সাচার গ্রামের রামকান্ত সূত্রধরকে বলেন। রামকান্ত সূত্রধর শ্রী বিগ্রহ নির্মাণে অপারগতা প্রকাশ করলে চাঁদপুর জেলাধীন মতলব উপজেলার অন্তর্গত বোয়ালিয়া গ্রামের সুদক্ষ কারিগর শ্রী কৃষ্ণকান্ত সূত্রধরকে আনা হয়। অতঃপর কৃষ্ণকান্ত সূত্রধর অত্যন্ত সুনিপুণভাবে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ও সুদর্শনের শ্রীবিগ্রহ নির্মাণ করেন। গঙ্গা গোবিন্দ সেন মহাশয় শ্রী বিগ্রহ নির্মাণের পাশাপাশি মন্দির নির্মাণের কাজও যথা সময়ে সম্পন্ন করেন।

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্নভাবে উদযাপ্নের জন্য সেন মহাশয় শ্রী রথ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিভিন্ন এলাকার সু-দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং কারুকার্যে সুনিপুণ সূত্রধর গণকে আহবান করেন। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ৫ জন শিল্পীকে রথ নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করেন।

শিল্পীগণ হলেন-(১) শ্রী রামকান্ত সূত্রধর (২) শ্রী রামকুমার সূত্রধর (৩) শ্রী কৃষ্ণকান্ত সূত্রধর (৪) শ্রী রামানন্দ সূত্রধর (৫) শ্রী চারু চন্দ্র সূত্রধর। উক্ত শিল্পীগণ নির্ধারিত সময়ে শ্রী রথের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন।

নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে রথ যাত্রার আগের দিন ১২৭৫ বাংলা সনের ১৬ই আষাঢ় শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান সুবিজ্ঞ ব্রাহ্মণ পন্ডিত দ্বারা অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের মাধ্যমে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং মহা অভিষেক ক্রিয়া সমাপন করা হয়। তার পর মন্দিরের প্রধান সেবক ভক্ত প্রবর শ্রী নরসিংহ পান্ডা কর্তৃক সর্ব প্রথম যখন পূজা করা হয় তখন তিনি শ্রী বিগ্রহের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তিনি জগন্নাথ দেবের সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করেন এবং ঐ দিন অপরাহ্নে কাঁদতে কাঁদতে সেন মহাশয় মন্দিরে প্রবেশ করে শ্রী বিগ্রহের দিকে তাকালে তিনিও জগন্নাথ দেবের সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করে কৃতার্থ হন। এভাবে সাচারে জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব ঘটে। এ মহৎকাজের জন্য গঙ্গাঁ গোবিন্দ সেন মহাশয় ভক্ত সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতি বছর নিয়মিতভাবে আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের ২য়া তিথিতে সাচার জগন্নাথ ধামে রথযাত্রা উদযাপিত হয়ে আসছে।

রথের বৈশিষ্ট্যঃশিল্পীগণ রথের চার পাশের কাঠ খোদাই করে বিভিন্ন দেবদেবী, পশু-পাখি, লতা-পাতা, ফুল-ফল প্রভৃতি দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত প্রতিকৃতি অংকন করেন। তাছাড়া কলি যুগে যে সকল সামাজিক অনাচার ও ব্যভিচার হচ্ছে বা হবে তার একটি চিত্র উক্ত রথে শিল্পীগণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যা দেখে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ অত্যন্ত বিমোহিত ও আকৃষ্ট হতেন।

          কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে বিবেচিত এবং চাঁদপুরের ঐতিহ্য স্বরূপ উক্ত রথটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পুড়ে ফেলে। এর পর ভক্তরা বাঁশের সাহায্যে রথ নির্মাণ করে রথযাত্রা উদযাপন করেন। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে রথটি পুন: নির্মাণ করা হয়। প্রতি বছর রথের দিনে এখানে বিশাল মেলা বসে।

এ মেলায় বাঁশ, বেত ও মাটির তৈরী বিভিন্ন রকমারী সৌখিন সামগ্রী ও কাঠের আসবাবপত্র, লোহা, তামা ও অন্যান্য ধাতু দ্বারা নির্মিত তৈজসপত্র, শিশুদের বিভিন্ন খেলার সরঞ্জাম ইত্যাদি পাওয়া যায়। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার অলংকার, পূজার সামগ্রী, মনোহারী দ্রব্য, হিন্দু মহিলাদের শঙ্খ, সিঁদুর, মৌসুমী ফল পাওয়া যায়। ফল সমূহের মধ্যে- আম, কাঁঠাল, আনারস, ও লটকন প্রচুর পরিমানে  বেচাকেনা হয়। তাছাড়া ফলদ ও বনজ বৃক্ষের চারা পাওয়া যায়।

 

 

চাঁদপুর জেলার লোকশিল্প ও চারুকলা

ঊনিশ শতকের শুরুতে চাঁদপুর লোকশিল্প ও চারুকলার দিক দিয়ে ছিল স্বর্ণযুগ ছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে চাঁদপুরে লোক ও কারুশিল্পের যে প্রসিদ্ধি লাভ করে তা এক গৌরবের ইতিহাস। চাঁদপুরের কিছু কিছু অঞ্চলে লোকশিল্পের প্রসার ঘটেছিল। কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় অনেক শিল্পই আজ হারিয়ে গেছে। বর্তমানে চাঁদপুর জেলার লোকশিল্প ও চারুকলাসমূহ আলোচনা করা হলোঃ

চাঁদপুর সদরঃ

কুমারঃ এ সম্প্রদায় আর আগের মত তাদের পূর্ব পুরুষদের ব্যবসা আকঁড়িয়ে নেই। পূর্বের ন্যায় কুমার সম্প্রদায়ের লোকদের হাuঁড়-কলসি বানানো দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না। সিলভারের তৈজস সামগ্রী তাঁদের তৈরী পণ্যের স্থান দখল করায় অনেকে তাঁদের পূর্ব পুরুষদের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে  পড়েছে। চাঁদপুর সদরের তবপুরচন্ডী ইউনিয়নে এবং পুরান বাজারে এখনও বেশ কিছু কুমার রয়েছে।

কামারঃ কামার সম্প্রদায় এখনও তাদের পূর্ব পুরুষদের ব্যবসা আকঁড়িয়ে আছে। তাদের তৈরি দা, বটি বর্তমানে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সমানভাবে সমাদৃত। অল্প সংখ্যক কামার সম্প্রদায়ের লোক তাদের পূর্ব পুরুষদের পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছে।

মুচিঃ জীবিকা নির্বাহের জন্য মুচি সম্প্রদায় রাস্তার পাশে ছোট পরিসরে তাদের পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন। মুচিদের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় বর্তমানে বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে তাদের পূর্ব পুরুষের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছে।

 

হাইমচর উপজেলাঃ এই উপজেলায় লোকশিল্প ও চারুকলার ইতিহাস নেই।

মতলব দক্ষিণ উপজেলাঃএই উপজেলায় লোকশিল্প ও চারুকলার কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না।

মতলব উত্তর উপজেলাঃ এই উপজেলায় লোকশিল্প ও চারুকলার কোন তথ্য নেই।

শাহরাস্তি উপজেলাঃভাস্কর সমীরণ দত্ত উপজেলার মেহার (উত্তর) ইউনিয়নের ঘুঘুশাল গ্রামের পাল বাড়িতে ভাস্কর সমীরুণ দত্ত গাছ ও মাটি দিয়ে বিভিন্ন নকশা তৈরী করেন। এ ছাড়া শাহরাস্তির বিভিন্ন গ্রামে কামার ও কুমার রয়েছে যারা এখনও তাদের পেশায় আছে।

ফরিদগঞ্জ উপজেলাঃ 

মৃৎ শিল্পঃ  এ উপজেলায় লোক ও কারু শিল্পের মধ্যে উলে­খযোগ্য হলো মৃৎ শিল্প পাইকপাড়া গ্রামে কুমার সম্প্রদায় এ শিল্পের সাথে শত বছরেরও বেশী সময় ধরে জড়িত রয়েছে। এ শিল্পের পণ্যের চাহিদা বর্তমানে  হ্রাস পাওয়ায় এ জনগোষ্ঠীর বেশীরভাগ পরিবার বর্তমানে বিভিন্ন পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করেছে।    

হাজীগঞ্জ উপজেলাঃ এই উপজেলায় লোকশিল্প ও চারুকলার কোন অবদান নেই।

কচুয়া উপজেলাঃএই উপজেলায় লোকশিল্প ও চারুকলার কোন ইতিহাস পাওয়া যায়নি।